বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ অপরাহ্ন
• অমিত হাসান:
” সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা “
রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর লেখা এই কথাগুলো দুনিয়ার আদি থেকে অন্ত সব যুগেই সমানভাবে সত্য । পৃথিবী যতই উন্নত-সমৃদ্ধ হোক না কেন কৃষি এবং কৃষককে বাদ দিয়ে কখনোই আগামীর পৃথিবী কল্পনা করা সম্ভব নয় । সংকটকালীন সময়ে মানুষ চাইলে হয়তো সোশ্যাল মিডিয়া বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করেও থাকতে পারে কিন্তু খাদ্যাভাবে থাকা কখনোই সম্ভব না ।
বস্তুত কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট চাষি তথা কৃষকেরাই আমাদের খাদ্যাভাব পূরণ করতে নিজেদের সর্বশ্ব উজাড় করে দেন । কখনো শীত সকালে ভোর কুয়াশায় কনকনে ঠান্ডার মধ্যে,আবার কখনো বা তীব্র তাপদাহে,আবার কখনো ঝড়বৃষ্টির মধ্যে অবিরত কাজ করে যান এই মানুষগুলো । তারাই নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, দিন-রাত পরিশ্রম করে মাঠে ফসল ফলান । তাঁদের সাধনার সেই ফসলে আমাদের অন্নসংস্থান হয়। শুধু তাই নয়, চাষিদের শ্রমে উৎপাদিত ফসল এ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
কিন্তু আমাদের সমাজ এই মহান পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকেদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পেরেছে কিনা সেই প্রশ্ন বহুকালের । মানুষের পাঁচ মৌলিক অধিকারের প্রথমটিই হচ্ছে খাদ্য । আর পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব হলেই দেশে দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ । আমাদের সুজলা সুফলা এই মাতৃভূমিও বিভিন্ন সময়ে দুর্ভিক্ষে কবলে পতিত হয়েছে । যার বড় কারণ ছিল কৃষি খাত নিয়ে চরম উদাসীনতা ও তীব্র খাদ্য সংকট ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়,ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা দখলের পর ১৭৭০ সালে (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) বাংলায় একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । যা পরবর্তীতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিতি পায় । অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সমগ্র দেশজুড়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় । ত্রুটিপূর্ণ ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ও খাদ্যবাজারে দালাল ফড়িয়া শ্রেণির দৌরাত্ম্যের ফলে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে ।
তাছাড়া ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে বাংলার মানুষকে আরেকটি দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে হয়েছিল । ১৯৪৩ সালের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) এই দুর্ভিক্ষটি বাংলা সন অনুযায়ী পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত । বিভিন্ন কারণে ১৯৩৮ সাল থেকে কৃষি ফসলের উৎপাদন কমতে থাকে এবং মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । তাছাড়া অতিরিক্ত মুনাফাভোগীদের দৌরাত্ম এবং অব্যবস্থাপনা তো ছিলোই ।
তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশ এখন কৃষি ক্ষেত্রে সংকট অনেকটা কাটিয়ে ওঠেছে । কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও কৃষি জমির পরিমাণ অনেকাংশেই কমেছে । যার অন্যতম কারণ উৎপাদন ব্যায় বৃদ্ধি ও কৃষক পর্যায়ে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া । তাছাড়া সময়ের সাথে বিভিন্ন আকর্ষণীয় পেশা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ হওয়াতেও অনেকে মাঠ পর্যায়ে কৃষিকাজ থেকে সরে আসছে ।
একবিংশ শতাব্দীর এই পর্যায়ে এসে আমরা ভুলে যাচ্ছি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জনগণের খাদ্য চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে । তাই উর্বর কৃষি জমি নষ্ট করে সেখানে দালান-কোঠা নির্মাণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে । এ কথা সত্য বাংলাদেশে এক সময় জিডিপিতে কৃষির উপর যে নির্ভরতা ছিল তা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে । কিন্তু জিডিপিতে কৃষি খাতের সরাসরি অবদান কমে গেলেও এ কথা স্বীকার করতেই হবে কৃষিই আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি ।এখনো দেশের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী কৃষিকাজের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে ।
কিন্তু কৃষির সাথে সরাসরি জড়িত লোকগুলোর অবস্থাটা আসলে কেমন ? শস্যবীজ, সেচ-কীটনাশক, বীজ বোনা,ফসল ওঠানোর মজুরিসহ পরিচর্যা বাবদ বিঘাপ্রতি সাধারণ কৃষকের যে খরচ হয় ফসল বিক্রি করে তাঁর যথাযথ মূল্য কি কৃষক পাচ্ছে ? বাংলার কৃষকদের বারোমাস্য অনেক প্রাচীন । একসময় যে গোয়াল ভরা ধান ছিল,পুকুর ভরা মাছ ছিল সে কথা এখন আর তেমন একটা শুনতে পাওয়া যায় না । বরং চর্যাপদের ‘হাড়ীত ভাত নাহিঁ নিতি আবেশী’ কিংবা অন্নদা মঙ্গলের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’—এ আকুতিই শোনা যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ।
ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর ফলে ব্রিটিশ শাসক ও বাংলার কৃষকদের মাঝে কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়েছিল । ব্রিটিশ প্রভু, জমিদার, জোতদার, নায়েব, বরকন্দাজ সবার ‘খাই’মেটাতে উৎপাদক শ্রেণি কৃষক হয়ে পড়েছিল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর । চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলনের পৌনে তিন শ বছর পেরিয়ে আমাদের কৃষকেরা মধ্যস্বত্বভোগীদের সেই ‘চিরস্থায়ী দৌরাত্ম্য’ থেকে কতটা মুক্তি পেয়েছে এখনো সে প্রশ্ন রয়েই যায় । এখনো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ কৃষকদের নিজেদের উৎপাদিত ফসল উৎপাদিত খরচের চেয়েও অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতে হয় । বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট কিংবা করপোরেটদের সঙ্গে সহজ সরল কৃষকেরা প্রতিযোগিতা করবেন কীভাবে ?
কৃষকদের দুর্দশা আরো বেড়ে যায় অতিবৃষ্টি,বন্যা,খড়া,নদীভাঙন বা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে । ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এমনিতেই বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। তাঁর উপর পুরো পৃথিবীর ন্যায় বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে । বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । এহেন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে কৃষকদের যে জনগণের খাদ্য জোগান দিতে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।
পৃথিবীর বর্তমান আর্থ ও সামাজিক অবস্থায় প্রতিদিনই বিশ্ব বাজারে কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কৃষিপণ্যের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে । তাই এখনই কৃষিতে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি । কীভাবে দেশে কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো যায় তা নিয়ে প্রচুর গবেষণার ব্যবস্থা করা উচিত । তাছাড়া যে অঞ্চলের মাটি উর্বর এবং চাষাবাদ ভালো হয় সেই অঞ্চলগুলোয় শিল্প,কলকারখানা তৈরি থেকে বিরত থেকে অপেক্ষাকৃত কম উর্বরতাসম্পন্ন মাটিতে দালান-কোঠা ও শিল্প কলকারখানা স্হাপনের ব্যবস্থা নেওয়া আশু জরুরি ।
অমিত হাসান
লেখক ও শিক্ষার্থী